Home / Uncategorized / আইএমএফের ষষ্ঠ কিস্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা কতটুকু

আইএমএফের ষষ্ঠ কিস্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা কতটুকু


বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচির আওতায় ধারাবাহিক অগ্রগতি দেখা গেলেও একটি জায়গাতেই বারবার হোঁচট খাচ্ছে—তা হলো রাজস্ব আদায়।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন আইএমএফের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। জ্বালানি ও সার আমদানির বকেয়া পরিশোধেও স্পষ্ট উন্নতি এসেছে। এমনকি রেমিট্যান্স প্রবাহে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। তারপরও কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ায় পরবর্তী কিস্তি ছাড়ের আগে বাংলাদেশকে আবারও আইএমএফের কাছে ‘ছাড়’ চাইতে হতে পারে।

আগামী ২৯ অক্টোবর থেকে দুই সপ্তাহের জন্য আইএমএফের একটি উচ্চপর্যায়ের দল ঢাকায় আসছে। তারা জুন পর্যন্ত অগ্রগতি পর্যালোচনা করবে। সফল মূল্যায়ন শেষে ডিসেম্বর নাগাদ প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের ষষ্ঠ কিস্তি ছাড় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

রিজার্ভে ইতিবাচক অগ্রগতি

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুনে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২০.৭৩ বিলিয়ন ডলার, যা আইএমএফের নির্ধারিত ১৭.৪ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। সেপ্টেম্বরে তা আরও বেড়ে ২০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি, আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থপাচার হ্রাস—এই তিনটি কারণেই রিজার্ভে দৃশ্যমান উন্নতি এসেছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “রেমিট্যান্স এখন সরকারি চ্যানেলে বেশি আসছে। কারণ, হুন্ডি বা অবৈধ পথে টাকা পাঠানো প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। পাশাপাশি আমদানি কম থাকায় ডলারের চাহিদাও হ্রাস পেয়েছে। ফলে বাজারে সরবরাহ বেশি, চাপ কম—এটাই রিজার্ভ বৃদ্ধির মূল কারণ।”

তিনি আরও যোগ করেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক এখন টাকার মান স্থিতিশীল রাখতে উল্টো ডলার কিনছে। আগে তারা বিক্রি করতো। অর্থাৎ বাজারে এখন চাহিদার চেয়ে জোগান বেশি।”

বকেয়া পরিশোধে দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য

আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, জুনে জ্বালানি ও সার আমদানির বৈদেশিক বকেয়া ৮৭০ মিলিয়ন ডলারের নিচে রাখার কথা।  সরকার তা কমিয়ে ৩১৪ মিলিয়ন ডলারে নামিয়েছে।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, “গত তিন মাসে সরকার জ্বালানি খাতের পাওনাদার আদানি ও শেভরনসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানিকে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে। এছাড়া সার আমদানির বিল বাবদ আরও ২০০ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছে।”

তিনি মনে করেন, এই অগ্রগতি আইএমএফের কাছে ইতিবাচক বার্তা পাঠাবে। তিনি বলেন, “বকেয়া কমানো মানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরছে। এটি ছিল আইএমএফের একটি শক্ত বার্তা—বাংলাদেশ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে।”

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বকেয়া নিষ্পত্তির অর্থায়ন করা হয়েছে বাজেটের অন্যান্য খাত থেকে পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে, যাতে উন্নয়ন ব্যয়ে চাপ না পড়ে।

রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি সবচেয়ে বড় উদ্বেগ

তবে সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটি রয়ে গেছে রাজস্ব সংগ্রহে। আইএমএফের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী গত অর্থবছরের জুন পর্যন্ত ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহের কথা ছিল। বাস্তবে আদায় হয়েছে মাত্র ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা—লক্ষ্যের চেয়ে ৬৫ হাজার কোটি টাকা কম।

বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এখনও ৮.৫ শতাংশের নিচে, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। আইএমএফ বারবার বলছে, রাজস্ব কাঠামো শক্তিশালী না হলে, ঋণ রাজস্ব কাঠামো শক্তিশালী না হলে ঋণ সহায়তা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হবে না।

এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “রাজস্ব আদায় কম হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে। প্রথমত, গত বছরের গণঅভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় স্থবির ছিল। দ্বিতীয়ত, এনবিআরের ভেতরে পুনর্গঠন ও কর্মীদের আন্দোলন কার্যক্রম ব্যাহত করেছে। তৃতীয়ত, আমদানি হ্রাসের কারণে শুল্ক আদায়ও কমে গেছে।”

তিনি আরও বলেন, “এই প্রেক্ষাপটে আইএমএফের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল বাস্তবতার তুলনায় অনেকটাই উচ্চাভিলাষী।”

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “রাজস্ব আদায় বাড়ানো ছাড়া বাজেট ঘাটতি কমানো যাবে না। সরকারকে কর প্রশাসনে কাঠামোগত সংস্কার আনতে হবে। আইএমএফের কাছে রাজস্ব ঘাটতির বিষয়ে ছাড় চাইতে হতে পারে, তবে সেটি বারবার করা যাবে না।”

আইএমএফের সম্ভাব্য প্রশ্ন

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত আইএমএফের ছয়টি বাধ্যতামূলক মানদণ্ডের বেশিরভাগ পূরণ করেছে। তবে সংস্থাটি দুটি বিষয়ে উদ্বেগ জানাতে পারে—বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার কেনার নীতি এবং  খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল সংক্রান্ত সাম্প্রতিক সার্কুলার।

আইএমএফের আশঙ্কা, বাজার নির্ধারিত বিনিময় হার নীতির পরও বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে কিনা, সেটি তারা যাচাই করবে।

জাহিদ হোসেন বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের যুক্তি থাকবে, তারা বাজারে স্থিতি রক্ষা করছে, নিয়ন্ত্রণ নয়। তবে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের অনুমতি দেওয়া হলে পুরোনো অনিয়মের পুনরাবৃত্তি হতে পারে।”

কর-সংস্কারের চাপ আরও বাড়ছে

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, কর আদায় বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রশাসনিক দুর্বলতা ও নীতি বাস্তবায়নের ধীরগতি। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে প্রণয়নাধীন ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’ কার্যকর হলে এনবিআর দুটি ভাগে বিভক্ত হবে—রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ। এতে কর সংগ্রহের কার্যকারিতা বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু আইএমএফ চায় এই কাঠামো ২০২৬ অর্থবছরের শুরুতেই চালু হোক।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, “যদি রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা আলাদা করা যায়, তবে কর আদায় ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়বে। তবে বর্তমানে এই কাঠামোগত সংস্কারের প্রক্রিয়া এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে।”

আইএমএফের সন্তুষ্টি পেতে কী করতে হবে

অর্থনীতিবিদদের মতে, আইএমএফের কিস্তি ছাড়ের সিদ্ধান্তে প্রধান বিবেচ্য হবে তিনটি সূচক—রিজার্ভ পরিস্থিতি,  রাজস্ব আদায় অগ্রগতি এবং ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা। এর মধ্যে রিজার্ভ ও বকেয়া পরিশোধে সাফল্য ইতিবাচক সিগন্যাল দিচ্ছে। কিন্তু রাজস্ব ঘাটতি ও ব্যাংক খাতের দুর্বলতা এখনও উদ্বেগের জায়গায়।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “রাজস্ব ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারকে কর প্রশাসনে দক্ষতা বাড়াতে হবে। শুধু নতুন কর বসালেই হবে না, করদাতাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। আইএমএফকে দেখাতে হবে যে বাংলাদেশ রাজস্ব কাঠামোতে টেকসই সংস্কার আনতে সক্ষম।”

কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কবে হবে?

বাংলাদেশ আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির শর্তগুলো ক্রমান্বয়ে পূরণ করছে, রিজার্ভ বাড়ছে, রেমিট্যান্সে রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে, বকেয়া পরিশোধেও শৃঙ্খলা ফিরেছে। কিন্তু রাজস্ব আদায় এখনও সেই পুরোনো দুর্বল জায়গাতেই রয়ে গেছে। আইএমএফের পরবর্তী কিস্তি হয়তো ডিসেম্বরেই ছাড় হতে পারে, কিন্তু রাজস্ব খাতের সংস্কার না হলে এই অগ্রগতি স্থায়ী হবে না—এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।





Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *